রাত তখন প্রায় সাড়ে দশটা। কলকাতার শেষ লোকাল ট্রেন ছেড়ে যাচ্ছে সিয়ালদহ থেকে। প্ল্যাটফর্ম ফাঁকা, কেবল অল্প কয়েকজন মানুষ।
মেঘলা আকাশের নিচে, একলা দাঁড়িয়ে ছিল মিতালী। নতুন অফিসে লেট শিফট করে ফিরছে, ক্লান্ত চোখে অপেক্ষা করছে ট্রেনের।
হঠাৎ করে পিছন থেকে এক কণ্ঠ—
“আপনি কি বারাসত যাচ্ছেন?”
মিতালী ঘুরে তাকাতেই দেখল, এক পরিচিত মুখ। অফিসের নতুন সহকর্মী, অরিজিৎ।
দুজনেই অবাক হয়ে একসাথে ট্রেনে উঠে বসল। ফাঁকা কামরা, শুধু দূরে দু-একজন যাত্রী।
ট্রেন ছেড়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অচেনা এক নীরবতা ভর করল চারপাশে। জানলার বাইরে অন্ধকার গ্রাম, ঝিকিমিকি আলো, আর ভেতরে তাদের দু’জনের মাঝে এক অদ্ভুত টান।
“আপনি কি প্রতিদিন এত রাতে ফেরেন?”—অরিজিৎ প্রশ্ন করল।
মিতালী হালকা হেসে বলল, “কাজের চাপটা জানেনই তো, অভ্যস্ত হয়ে গেছি।”
কথা চলতে চলতে হঠাৎ ট্রেন থেমে গেল মাঝপথে। সিগন্যাল নেমে গেছে। কামরায় বাতি জ্বলছে, কিন্তু চারপাশে নিস্তব্ধতা।
মিতালী একটু ভয় পেয়ে জানালার বাইরে তাকাচ্ছিল। অরিজিৎ ধীরে ধীরে বলল—
“চিন্তা করবেন না, আমি আছি।”
সেই মুহূর্তে এক অদ্ভুত নিরাপত্তাবোধ কাজ করল মিতালীর ভেতরে।
এতদিন অফিসে শুধু সহকর্মী হিসেবে দেখেছিল, কিন্তু আজ মনে হল, লোকটার চোখে এক অদ্ভুত আন্তরিকতা আছে।
ট্রেন আবার ছাড়ল, কিন্তু এখন আর নীরবতা নেই। দুজনেই একে অপরকে জীবনের গল্প বলতে শুরু করল।
মিতালী বলল তার ব্যর্থ প্রেমের কথা, একসময় বিয়ে ভেঙে যাওয়ার যন্ত্রণা।
অরিজিৎ বলল তার একাকী জীবনের কথা, বাবা-মা হারিয়ে একা থাকার অভ্যাসের কথা।
এই ভাগাভাগি করা কষ্টগুলো হঠাৎ করে তাদের কাছাকাছি এনে দিল।
হঠাৎ করেই ট্রেন আবার অন্ধকার টানেলে ঢুকল। জানলার বাইরে কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
মিতালী নিঃশব্দে হাত রাখল অরিজিতের পাশে। অরিজিৎও হাতটা শক্ত করে ধরল।
কোনো কথা ছিল না, শুধু চোখের ভাষা।
ট্রেন যখন আলোতে বেরোল, তারা দুজনেই বুঝল—আজকের রাতটা তাদের সম্পর্ককে অন্য এক স্তরে নিয়ে গেল।
এটা শুধুই সহকর্মীর আলাপ নয়, বরং এক নতুন আবেগ, এক নতুন আকাঙ্ক্ষার সূচনা।
শেষ ট্রেনের এই অচেনা যাত্রাই হয়তো তাদের জীবনের নতুন অধ্যায় খুলে দিল।