স্যার, আমি আপনার কাছে এসেছি একটা সমস্যায় পড়ে। আমি আপনার ছাত্রী নীলাসার বাবা। ক্লাসে হয়ত ওকে দেখে থাকবেন, গোলগাল চেহারা, ফর্সা করে, শান্তশিষ্ট?’
মৈনাক বাবুর কথা শুনে দিপ্তীময় দত্তর মনে ভার্সিটিতে তার প্রথম ক্লাসের দৃশ্য ভেসে উঠে। তিনি ক্লাসে ঢুকতেই সবগুলো মেয়ে হুল্লোর করে শিস দিয়ে উঠেছিল। লেকচার শুরু করার পর সবাই বলতে গেলে লাফাচ্ছিল। ফার্স্ট ডেস্কে বসা একটি মেয়ে শুধু যেন এই জগতে ছিলনা। তার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়েছিল পুরোটা ক্লাস জুড়ে। মেয়েটার পরীর মত সুন্দর মুখের দিকে কোনমতে একবার তাকিয়েই তার মনে হয়েছিল আগুনের লেলিহান শিখার দিকে তাকিয়েছেন। এরপর থেকে প্রতি ক্লাসেই মেয়েটা তার দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকত। তা দেখে তার সহপাঠীরা দিপ্তীময় দত্ত ক্লাসে এলেই কি সব গুজুরগুজুর করে হাসাহাসি করত তা অনুমান করা এ বিষয়ে অনভিজ্ঞ দিপ্তীময় দত্তর ধারনার বাইরে। তবে দিপ্তীময় দত্তর ব্যাপারটা ভালোই লাগত। গত কিছুদিন ধরে মেয়েটার অনুপস্থিতিতে একটু অবাক হওয়ার সাথে সাথে তিনি একটু আশাহতও হয়েছিলেন।
‘স্যার!’ মৈনাক বাবুর ডাকে দিপ্তীময় দত্ত বাস্তবে ফিরে আসেন।
‘আ…হ্যা নীলাসা, হ্যা দেখেছি ওকে। ও তো বোধহয় কদিন ধরে ভার্সিটিতে আসছে না?’
‘হ্যাঁ স্যার এজন্যই আপনার কাছে আসা। শুনেছি আপনি নাকি পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন এবনরমাল মানসিক সমস্যার সমাধানও করে থাকেন?’
‘তা একটু আধটু করি বটে, তা সমস্যাটা কি?’
‘সমস্যাটা আসলে স্যার আমার মেয়েকে নিয়ে’ মৈনাক একটু নড়েচড়ে বসেন। ‘কদিন ধরেই মেয়েটা কিছুই খায় না, ঘুমায় না, সারাক্ষন শুধু ভার্সিটিতে ছুটে যেতে চায়। তবে কিনা…’
‘হ্যা হ্যা বলুন’ দিপ্তীময় দত্ত মৈনাককে তাগিদ দেন।
‘…এম…ওর গায়ে কোন কাপড়ই রাখতে চায় না। তাই ওকে চাদরে জড়িয়ে বেধে রাখতে হচ্ছে। তার উপর কদিন ধরে বাচ্চা মেয়ের মত খালি…এম…ললিপপ খেতে চাচ্ছে। বিরক্ত হয়ে তাও এনে দিয়েছিলাম কিন্ত সাথে সাথে ওটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে বলেছে এই পঁচা ললিপপ নাকি খাবে না। তার আবার ললিপপ খাবো বলে চিৎকার করা শুরু করেছে। কি যে করি কিছুই বুঝছি না’
‘আচ্ছা ‘ললিপপ খাবো’ এটা বলা ছাড়া কি আর অস্বাভাবিক কিছু করছে?’
‘না এছাড়া সম্পুর্ন স্বাভাবিক’
দিপ্তীময় দত্ত মৈনাকের কথা শুনে চিন্তায় পড়ে গেলেন। এ আবার কি রহস্য। এতো বড় মেয়ে আবার ললিপপ খেতে চাবে কেন? উনি উঠে দাড়ালেন।
‘চলুন তো আপনার মেয়েকে একবার দেখা দরকার’
‘চলুন’
দিপ্তীময় দত্ত দ্রুত তার রুমে গিয়ে তৈরী হয়ে মৈনাকের সাথে বের হয়ে গেলেন।
‘এদিক দিয়ে আসুন স্যার। নীলাসার রুম দোতলায়।’ মৈনাক বাবু দিপ্তীময় দত্তকে ওনাদের বিশাল ডুপ্লেক্সের ভিতরে পথ দেখান। উপরে উঠে লবির কোনার একটা বন্ধ দরজার দিকে দিপ্তীময় দত্তকে নিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলেন মৈনাক বাবু। দরজার কাছাকাছি যেতেই হঠাৎ করে দরজাটা খুলে গেল; একটি বেশ সুন্দরী মেয়ে বের হয়ে এল। দিপ্তীময় দত্ত অবাক হয়ে দেখলেন মেয়েটির চোখে ল কিন্ত মুখে হাঁসি লেগে আছে। বোধহয় হাঁসতে হাঁসতে চোখে জল চলে এসেছিল। সে দিপ্তীময় দত্ত ও মৈনাক বাবুকে দেখে হাসি থামিয়ে একটু থমকে দাড়ালো।
‘সুমি, ইনিই দিপ্তীময় দত্ত স্যার, নীলু মাকে দেখাতে নিয়ে এলাম’ মৈনাক বাবু মেয়েটির কাছে দিপ্তীময় দত্তর পরিচয় দিলেন। ‘স্যার ও হচ্ছে আমার বড় ছেলের বৌ, সুমি’ উনি দিপ্তীময় দত্তর দিকে ফিরে বললেন।
দিপ্তীময় দত্তর নাম উচ্চারিত হতেই কি এক অদ্ভুত কারনে সুমির মুখে আবার হাঁসিটা ফিরে এল। সে দিপ্তীময় দত্তর উদ্দেশ্যে হাল্কা করে মাথাটা একটু ঝুকিয়ে নিয়ে হাঁসতে হাঁসতেই চলে গেল। দিপ্তীময় দত্ত একটু অবাক হলেও ব্যাপারটা খুব একটা গুরুত্ব দিলেন না। কিন্ত নীলাসার রুমে ঢুকেই সেখানের দৃশ্য দেখে দিপ্তীময় দত্তর মুখে কথা সরলো না। ঘরের এককোনে একটা বিছানার সাথে কাপড় দিয়ে বেধে রাখা, চাদরে জড়ানো এক ডানাকাটা পরী। নীলাসা একটু শুকিয়ে গিয়েছে, আর তার মুখও একটু ম্লান, তবুও তার মধ্য থেকে কেমন যেন একটা জৌলুস বেরিয়ে আসছিল। নীলাসা জানালার দিকে তাকিয়ে ছিল। ওনাদের ঘরে ঢোকার শব্দ হতে সে ফিরে তাকালো। দিপ্তীময় দত্তকে দেখতে পেয়েই তার মুখ যেন এক আগুনে আভায় প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠল।
‘ললিপপ!! ইয়াহু!! ললিপপ!!’ ওর মুখ দিয়ে আনন্দের চিৎকার বের হয়ে এল।
দিপ্তীময় দত্ত তো বটেই নীলাসার বাবাও ভ্যাবাচেকা খেয়ে গিয়েছেন। গত কয়দিনে নীলাসাকে এরকম অন্য আলোয় জ্বলে উঠতে দেখেননি তিনি। দিপ্তীময় দত্ত কি করবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না। ওদিকে নীলাসা চেচিয়েই চলেছে, ‘উমমম…আমার ললিপপ…বাবা…তুমি এখানে দাঁড়িয়ে কি করছ? চলে যাও, আমি আমার ললিপপ খাবো…উমম…ইশ! আমাকে এতো শক্ত করে বেঁধেছে কে?’