পিয়নের ডাক শুনে দিপ্তীময় দত্ত বাস্তবে ফিরে আসেন। হাতের সাইকোলজি টুডেটা থেকে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলেন এরই মধ্যে ডিপার্টমেন্ট ফাকা হয়ে গিয়েছে। ফ্যামিলি ইনসেষ্ট প্রবনতার মানসিক কারন বিষয়ে একটা আর্টিকেলে ডুবে গিয়ে তিনি সময়ের হিসেবই হারিয়ে ফেলেছিলেন। তিনি চেয়ার থেকে উঠতে গিয়ে পিয়নের দিকে তাকালেন।
‘এই তোকে না বলেছি শুদ্ধ করে কথা বলতে?’
‘আআআমি কি কই ছার, আপনেও তো…’ পিয়ন আমতা আমতা করে।
‘চোপ!’ দিপ্তীময় দত্তর মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। উনি টেবিল থেকে কয়েকটা লেকচার শিট নিয়ে ডিপার্টমেন্ট থেকে বের হয়ে এলেন। সরু করিডোর দিয়ে হাটতে হাটতে ওনার মন বিরক্তিতে ভরে গেল। কদিন হলো উনি থার্ডক্লাস ইউনিভার্সিটির সাইকোলজি ডিপার্টমেন্টে সরাসরি অ্যাসিন্টেনন্ট প্রফেসর হিসেবে জয়েন করেছেন। এই বিল্ডিং দেখে প্রথমে উনি ভেবেছিলেন এটা বুঝি অফিস। পরে জেনেছেন এটাই মূল ভবন। ক্লাসের কাছাকাছি যেতেই হঠাৎ কোত্থেকে যেন দুটো মেয়ে উদয় হয়ে একেবারে ওনার গায়ে ধাক্কা লাগিয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেল। থেমে গিয়ে চরম বিরক্তিতে দিপ্তীময় দত্ত পিছনে তাকিয়ে তাদের হাসির আওয়াজ মিলিয়ে যাওয়া পর্যন্ত তাকিয়ে রইলেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার ক্লাসের দিকে রওনা দিলেন তিনি। জয়েন করার দিন থেকেই চলছে এসব। ভার্সিটির সব মেয়েই যেন তার সাথে ধাক্কা লাগাতে উন্মুখ। অথচ মেয়েদের থেকে সবসময় একশ হাত দূরে থাকার চেষ্টা করেন তিনি। ভার্সিটিতে পড়ানোর পাশাপাশি তিনি শখের বশে বিভিন্ন এবনরমাল রহস্যের মীমাংসাও করে থাকেন।
তবে মেয়েদের মনের রহস্যটার আজ পর্যন্ত কোন কিনারা করতে পারেননি বলেই চল্লিশোর্ধ দিপ্তীময় দত্ত আজও অবিবাহিত। কলেজে পড়ার সময় একবার উনি বন্ধুদের সাথে মাঠে ফুটবল খেলছিলেন। তাদের খেলার স্থান থেকে একটু দুরেই দুই কপোত-কপোতী ভালোবাসায় বুদ হয়ে ঢলাঢলি করছিল।
খেলার মাঝে হঠাৎ বল গড়িয়ে তাদের পিছনে একটা ঝোপে চলে গিয়েছিল। অতগ্য দিপ্তীময় দত্তকে যেতে হলো বল আনতে। এই প্রেমিক যুগলকে ডিঙ্গিয়ে বল আনা সম্ভব ছিল না; তাই উনি মেয়েটাকে শুধু বলেছিলেন, ‘দিদি ফুটবলটা দেন, খেলব’ প্রেমের নেশায় মত্ত মেয়েটা এতে কি বুঝেছিল কে জানে। এরপর তার প্রেমিকের রামধোলাইয়ে তিনদিন বিছানা থেকে উঠতে পারেননি দিপ্তীময় দত্ত।
এই ঘটনার পর থেকে আজও মেয়েদের সামনে সহজভাবে কিছু বলতে পারেন না দিপ্তীময় দত্ত। কিন্ত এখানে এসে তার মনে হচ্ছে বাংলাদেশে বুঝি ছেলের আকাল পড়েছে। উনি ক্লাসে ঢুকতেই সব মেয়ের নজর ঘুরে গেল তার দিকে। কয়েকটা মেয়ে একযোগে শিস দিয়ে উঠল। মেয়েরাও যে শিস দেয় এটা দিপ্তীময় দত্ত আগে জানতেন না; তাও আবার তার দিকে তাকিয়ে! মেয়েগুলো কি আসলে তার নিয়মিত ব্যায়াম করে এখনো রক্ষা করা সুস্বাস্থ্যের প্রতি আকৃষ্ট না তাকে জ্বালাতনের জন্য এসব করে এটা তিনি এখনো বুঝে উঠতে পারেননি।
দিপ্তীময় দত্ত মুখ নামিয়ে ক্লাসে ঢুকে লেকচার স্টেজে উঠলেন; ধমক দেবেন কি মেয়েগুলো কোন প্রশ্ন করলেও উনি আমতা আমতা করতে থাকেন। ওরা শিস বাজিয়েই যাচ্ছে। দিপ্তীময় দত্ত শিটগুলো বের করে কোন মতে তাদের দিকে তাকাতে শিস একটু কমে এল। ছেলেগুলো সব নিরব হাসিতে ফেটে পড়ছে। একটা গলা খাকারী দিয়ে উনি শুরু করলেন।
‘তো…আজকে তোমাদের লেকচারের টপিক হলো……’
‘ছেলেদের সেক্সুয়ালিটি!!’ ওনার কথার পিঠেই একটা মেয়ে বলে উঠল।
দিপ্তীময় দত্ত একবার চোখ দিয়ে মেয়েটাকে ভষ্ম করার ব্যর্থ চেষ্টা করে বলে গেলেন, ‘আজ তোমাদের লেকচারের টপিক হলো আনন্যাচারাল বিহেভিয়ারস অফ হিউম্যান মাইন্ড। তো আজ তোমাদের আমি…’
‘করবেন স্যার!!?? কি মজা! কাউগার্ল স্টাইলে নিশ্চয়ই?’ আরেকটা মেয়ে বলে উঠতেই সবাই একসাথে হাততালি দিয়ে উঠে।
অসহ্য দিপ্তীময় দত্ত না পারছেন ধমক দিতে না পারছেন ক্লাস থেকে বের হয়ে যেতে। অতগ্য পাত্তা না দিয়ে আবারও শিট টেনে নিয়ে নিজের মত করে পড়া শুরু করলেন।
সারদিন ভার্সিটিতে মেয়েগুলোর জ্বালাতনে অতিষ্ট দিপ্তীময় দত্ত অবশেষে বাসায় এসে হাফ ছাড়লেন। ড্রাইভার আজ ছুটিতে বলে আসতে হয়েছে বাসে। তাই মানসিক ও শারীরিক দুই দিক থেকেই ক্লান্ত হয়ে ছিলেন তিনি।
শাওয়ার নিয়ে, কাপড়-চোপড় বদলিয়ে ডাইনিংয়ে গিয়ে ওনার এক দূরসম্পর্কের মাসির রান্না করে রেখে যাওয়া খাবার খেতে বসলেন। মাসি ওনার গ্রামেরই মানুষ, কাছেই একটা ঘিঞ্জি এলাকায় থাকেন। মাসি গরীব বলে তাকে মাসে মাসে কিছু টাকা দেন তিনি, আর উনি এসে দিপ্তীময় দত্তর প্রতিদিনকার রান্নাটা করে দিয়ে ঘরদোর গুছিয়ে দিয়ে যান। খেতে খেতে দিপ্তীময় দত্তর মনে আজ এক অন্যরকম ফাকা ফাকা একটা অনুভুতি হচ্ছিল। বারবারই মনে হচ্ছিল এসময় পাশে কেউ একজন থাকলে এই বিরক্তিকর খাওয়ার সময়টিই কতটা উপভোগ্য হয়ে উঠতে পারত।
সারাদিন ভার্সিটি ক্যাম্পাসের কোনে কোনে দেখা কপোত-কপোতীদের কথা মনে করে তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কোনমতে খাওয়া শেষ করে হাত মুখ ধুয়ে ওনার ছোট স্টাডিটায় গিয়ে এই মাসের সাইকোলজি টুডেটা হাতে নিয়ে আরামকেদারায় দেহ এলিয়ে দিলেন। তার নিসঙ্গ জীবনের একমাত্র আনন্দ এই বই পড়াই। কিন্ত বেশিক্ষন সে আনন্দ তিনি উপভোগ করতে পারলেন না। বেলের শব্দে তাকে আবার বইয়ের জগৎ থেকে ফিরে আসতে হলো। বিরক্ত হয়ে আরাম কেদারা থেকে উঠে দরজার দিকে পা বাড়ালেন উনি। এই সময় আবার কে এলো? দরজা খুলে একজন অপরিচিত লোককে দেখতে পেয়ে একটু অবাক হলেন দিপ্তীময় দত্ত।
‘নমস্কার, স্যার আমি মৈনাক সেন, আপনার এক ছাত্রীর বাবা। আপনার সাথে কিছু কথা ছিল।’ লোকটা বলে উঠল।
‘ও আচ্ছা আচ্ছা, ভেতরে আসুন’ বলে দিপ্তীময় দত্ত মৈনাক বাবুকে ঘরে ঢুকিয়ে তার ড্রইংরুমে নিয়ে বসালেন।
‘তো বলুন, আমি আপনার জন্য কি করতে পারি?’ দিপ্তীময় দত্ত সোফায় বসতে বসতে বললেন।